চ্যাম্পিয়ন্স লিগের একটা ম্যাচে প্রথমার্ধে দুই গোল হজম করার পর সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো যেকোনো প্রেক্ষাপটেই ভীষণ কঠিন কাজ। বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে রিয়াল মাদ্রিদ ঠিক সেটাই করেছে, উল্টো পেয়েছে বড় জয়ও। আর দুর্দান্ত এক হ্যাটট্রিকে তাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ভিনিসিয়ুস জুনিয়র। ব্রাজিলিয়ানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় মেতেছেন কোচ কার্লো আনচেলত্তি। তার চোখে তরুণ এই ফরোয়ার্ড যা করেছেন, সেটা বিরল কিছুরই সামিল।
গত মঙ্গলবার রাতের ম্যাচে ৩৪ মিনিটের মধ্যে দুই গোল হজম করে বসে রিয়াল। তবে দ্বিতীয়ার্ধে বদলে যায় চিত্র। একে একে তিন গোলকরে স্প্যানিশ ক্লাবটির জয়ের মঞ্চ সাজিয়ে দেন ভিনিসিয়ুস। সাথে আন্টোনিও রুডিগার ও লুকাস ভাসকেসের গোলে ৫-২ ব্যবধানে জয় পায় রিয়াল। দ্বিতীয়ার্ধে ভিনিসিয়ুস বলতে গেলে একাই ডর্টমুন্ডের রক্ষণে ভাঙন ধরিয়েছেন বারবার।
ম্যাচ শেষে তাই ভিনিসিয়ুসকে বাড়তি প্রশংসায় ভাসালেন আনচেলত্তি।
“আমি যা বলতে পারি তা হল, ভিনিসিয়ুস দ্বিতীয়ার্ধে যেভাবে খেলেছে, একজন খেলোয়াড়কে সেভাবে দেখাটা বিরল ব্যাপার। এটা স্রেফ তিনটা গোলের কারণেই নয়, এটা তার খেলার ধরণের কারনেও। সেটা দুর্দান্ত ছিল।”
এই মাসেই জানা যাবে এবারের ব্যালন ডি’অর জয়ীর নাম। সব ঠিক থাকলে সেটা জিততে যাচ্ছেন ভিনিসিয়ুস। স্পেনের রদ্রি প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও রিয়াল তারকার চেয়ে পিছিয়েই আছেন তিনি। গত মৌসুমে আনচেলত্তির দলের লা লিগা ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ে বড় অবদান ছিল ভিনিসিয়ুসের।
আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না এলেও আনচেলত্তি নিশ্চিত, ভিনিসিয়ুসের হাতেই উঠতে যাচ্ছে ব্যালন ডি’অর। “
ভিনিসিয়ুস (ব্যালন ডি'অর) জিততে যাচ্ছে, আর এটা সে আজ রাতে যা করেছিলেন সেজন্য বলছি না, এটা সে গত বছর যা যা করেছে তার জন্য। এই তিনটি গোল আগামী বছরের ব্যালন ডি'অরের জন্য বিবেচনায় থাকতে যাচ্ছে, এটি নিশ্চিত। সে এমন একজন খেলোয়াড় যাকে নিয়ে সমর্থকরা গলা ফাটায়, কারণ সে পার্থক্য গড়ে দিতে পারে।”
ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে প্রথমার্ধে নিজেদের ছায়া হয়েই ছিল রিয়াল। দুই গোল হজমে জেগেছিল হারের আশঙ্কাও। তবে সেই একই দল বিরতির পর একদম চিত্র বদলে দেয়। একে একে পাঁচ গোল দিয়ে যেভাবে জিতেছে, সেটা দেখে মনে হতেই পারে যে ম্যাচটা হয়ত একতরফা ছিল। তবে বাস্তবতা বলছে, দ্বিতীয়ার্ধের পারফরম্যান্সই মূলত স্কোরলাইন এমন একটা অবস্থায় নিয়ে গেছে।
এমন পারফরম্যান্সের রহস্য কী? সবসময়ের ধীরস্থির আনচেলত্তি জবাব দিয়েছেন চেনা ঢঙ্গেই।
“আমরা বিরতির সময় স্থির ছিলাম, বিচলিত হইনি। আমরা সিস্টেম পরিবর্তন করেছি এবং আরও দৃঢ়ভাবে ম্যাচে ফিরে এসেছি। তিন গোল করার ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে, তাই আমরা সেই সময়ে ভালোভাবে পাস দেওয়া, ডুয়েল জেতার মতো ছোটখাটো বিষয় নিয়ে কথা বলেছি।”
বার্সেলোনা রীতিমত উড়ছে। বার্সাকে থামাতে গিয়ে কেউ বাধা পড়ছেন অফসাইডের ফাঁদে, আর তা না হলে বিপরীত পোস্টে ইয়ামাল-লেভানডফস্কি-রাফিনিয়ার মুহুর্মুহু আক্রমণে প্রতিপক্ষ ভেসে যাচ্ছে গোলবন্যায়। শেষ পাঁচ ম্যাচে রিয়াল-বায়ার্নসহ বার্সা গোল করেছে ২১ টা, সব প্রতিযোগিতা মিলে সেটা ৫০ ছুঁয়েছিল রেড স্টারের বিপক্ষে ম্যাচের আগেই। বার্সেলোনার এই ‘গোলমেশিন’ যেন অটো মোডে এভাবেই গোল করে যায়, সেটাই প্রত্যাশা বার্সেলোনার জার্মান কোচ হান্স দিতার ফ্লিকের।
রেড স্টারের বিপক্ষে এক পর্যায়ে ১-১ এ সমতা থাকলেও বার্সেলোনা ম্যাচটা শেষ করেছে ২-৫ স্কোরলাইনে। সে সঙ্গে ৭৪ বছরের পুরোনো একটা রেকর্ড ভেঙে চুরমার করে ফেলেছে ফ্লিকের দল। এই মুহূর্তে সব কম্পিটিশন মিলে ১৬ ম্যাচ খেলেছে বার্সেলোনা, তাতে ম্যাচপ্রতি ৩.৪ গোল হারে তারা গোল করেছে ৫৫ টি। এর আগে স্লোভাক কোচ ফার্দিনান্দ দাউচিকের অধীনে ১৯৫০-৫১ সালে বার্সেলোনা প্রথম ১৬ ম্যাচে করেছিল ৫৪ গোল। এবারের ভয়ঙ্কর বার্সেলোনার কাছে ভেঙে গেল এত বছরের পুরোনো রেকর্ডটাও, যা কি না অক্ষত ছিল লিওনেল মেসি, ইব্রাহিমোভিচ, সুয়ারেজ, নেইমারদের সময় যাবার পরও। ওসাসুসানের কাছে ৪-২ গোলে হারার পর প্রতি ম্যাচেই তিনের অধিক গোল করেছে কাতালান ক্লাবটি। এই ১৬ ম্যাচের মধ্যে তারা তিন বা এর অধিক গোল করেছে ১০ ম্যাচে।
আরও পড়ুন
জিতেও যে কারণে দলের পারফরম্যান্সে সন্তুষ্ট নন ফ্লিক |
কিন্তু এরকম ভয়াবহ গোলক্ষুধার পেছনে রহস্যটা কী? হান্সি ফ্লিক কী এমন জাদু করলেন যে খেলোয়াড়রা গোলমুখে এত ধারাবাহিক হয়ে উঠেছে? উত্তরটা স্মিত হেসে ফ্লিক নিজেই দিয়েছেন, বলছেন তার ফুটবলারদের মধ্যে ‘প্রতিযোগিতার মানসিকতা’ থাকার কারণেই বার্সায় চলছে সুসময়-
“আমরা প্রতিটা ম্যাচে আলাদা করে নজর দিচ্ছি, সেটা আপনারাও হয়তো দেখছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ম্যাচে খেলোয়াড়রা ওদের সেরাটা দিচ্ছে। মাঠে সেটা ওরা ভালো বোঝে এবং তাদের সফল হতে দেখাটা আনন্দদায়ক।”
বার্সেলোনার এই গোলের ধারা অব্যাহত রাখার ব্যাপারেও জোর দিচ্ছেন ফ্লিক, বলছেন মৌসুমের এখনো অনেক সময় বাকি-
“আশা রাখছি ওরা এমনটা ধরে রাখতে পারবে। আমাদের সেই আত্মবিশ্বাসটা আছে। এটা শুধু একটা ম্যাচে ভালো করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং আমরা মৌসুমে এখন পর্যন্ত যে কয়টা ম্যাচ খেলেছি– সেটা মাথায় রেখেই আমরা এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চাই।”
চ্যাম্পিয়নস লিগে এরকম ম্যাচের পর ম্যাচে গোল করা অতীত বার্সেলোনার সন্ধান পেতে চাইলে আপনাকে ফিরে যেতে হবে ২০১১-১২ সালে। সেবার টানা তিন ম্যাচে তিন বা তার অধিক গোল করেছিল বার্সেলোনা, ১২ বছর পর সেটা বার্সেলোনা আবারো করে দেখালো ইয়াং বয়েজ আর রেড স্টারের জালে পাঁচ এবং বায়ার্নের জালে ৪ গোল দিয়ে।
আরও পড়ুন
এল ক্লাসিকোর জয়ে গর্বিত ফ্লিক |
চ্যাম্পিয়নস লিগে ৪ ম্যাচ শেষে ৯ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের ষষ্ঠ স্থানে আছে বার্সেলোনা। চ্যাম্পিয়নস লিগে বার্সেলোনার পরবর্তী অ্যাসাইনমেন্ট এবারের চমক ফ্রেঞ্চ ক্লাব ব্রেঁস। তবে তার আগে লা লিগাতে রিয়াল সোসিয়েদাদ ও সেলতা ভিগোর সঙ্গে ম্যাচ খেলবে তারা।
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, লিওনেল মেসির পর ৩য় ফুটবলার হিসেবে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে শততম গোলদাতার তালিকায় ঢুকতে যাচ্ছেন রবার্ট লেভানদোভস্কি। এখন পর্যন্ত উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে এই স্ট্রাইকারের গোল সংখ্যা ৯৯।
চ্যাম্পিয়নস লিগে গেল রাতে রেড স্টারের বিপক্ষে জোড়া গোল করে নিজেকে ৯৯’র ঘরে নিয়েছেন বার্সেলোনার এই স্ট্রাইকার। তিন অঙ্কের ম্যাজিকাল ফিগারে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ব্রেস্টের বিপক্ষে পরের ম্যাচের জন্য। রেড স্টারের বিপক্ষে মাঠে ছিলেন ৭৮ মিনিট পর্যন্ত, পুরো সময় পেলে হয়তো চ্যাম্পিয়নস লিগে শততম গোলের অপেক্ষাটা ফুরিয়ে ফেলতে পারতেন এই স্ট্রাইকার। ম্যাচ শেষে বার্সেলোনা কোচ হ্যান্সি ফ্লিকও রসিকতা করে সেই আফসোসটাই করেছেন-
“এটা আমি জানতাম না, জানলে হয়তো পুরো ম্যাচ না খেলিয়ে আমি তাকে বদল করতাম না।”
এর আগে বায়ার্ন মিউনিখ ও বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচ খেলেছেন লেভানদোভস্কি। ৯৯ চ্যাম্পিয়নস লিগ গোলের ৬৯টাই করেছেন বাভারিয়ানদের হয়ে। যা একক কোন ক্লাবের হয়ে গোলের হিসেবে রয়েছে ৪র্থ স্থানে। বার্সেলোনার জার্সি গায়ে মেসির গোল ১২০, রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর গোল ১০৫, কারিম বেনজেমাও রিয়ালের হয়ে করেছেন ৭৮টি গোল।
আরও পড়ুন
ভিনির মন খারাপ, তবে সেটা ভ্যালেন্সিয়ার বন্যার্তদের জন্য : আনচেলত্তি |
২০১৯/২০ চ্যাম্পিয়নস লিগে এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি গোল করেছিলেন রবার্ট লেভানদোভস্কি। সেবার বায়ার্ন মিউনিখকে ইউরোপ সেরার মুকুট এনে দিয়েছিলেন এই পোলিশ স্ট্রাইকারই। গোল করেছিলেন পুরো আসর জুড়ে ১৫টা।
বার্সেলোনার হয়ে এই মৌসুমে ৪ ম্যাচে গোল করেছেন ৫টি। সব মিলিয়ে বার্সার জার্সিতে চ্যাম্পিয়নস লিগ গোল হলো ১৩টি।