৫ মার্চ ২০২৫, ৯:০৮ পিএম
অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে ওয়ানডেতে তার চেয়ে বেশি শতক আছেই কেবল পাঁচজনের। টেস্ট ক্রিকেটে নিজেকে অন্যন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার কারণেই হয়ত স্টিভেন স্মিথের ৫০ ওভারের পরিসংখ্যান অনেকটাই আড়ালে চলে গেছে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকে অস্ট্রেলিয়ার বিদায়ের পর তার এই ফরম্যাট থেকে আকস্মিক অবসরের ঘোষণা তাই খুব একটা আলোড়ন ফেলতে পারছে না। অথচ সব পরিস্থিতিতে, সব কন্ডিশনে অজিদের হয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে স্মিথ যেভাবে রাঙিয়েছেন নিজেকে, তাতে দেশটির ইতিহাসের অন্যতম সেরাদের কাতারে থাকার দাবিদার তিনি।
২০১০ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে পাঁচ উইকেট পতনের পরও ব্যাটিংয়ের সুযোগ মেলেনি স্মিথের। দলে যে ছিলেন লেগ স্পিনিং অলরাউন্ডার। সেই একই খেলোয়াড় নিজের শেষ ওয়ানডেতে ভারতের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ব্যাট করেছেন তিন নম্বরে। চাপের মুখে খেলেছেন ৭৩ রানের এক ইনিংস। লেগ স্পিনার থেকে সময়ের অন্যতম সেরা ব্যাটারদের একজন হয়ে ওঠার ১৫ বছরের পথচলায় ৩৫ বছর বয়সী এই ব্যাটারের ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যান দাঁড়িয়েছে ১৭০ ম্যাচে ১৫৪ ইনিংসে ৫ হাজার ৮০০ রান। সেঞ্চুরি ১২টি, ফিফটি ৩৫টি, গড় ৪৩.২৮ গড় আর স্ট্রাইক রেটটাও দারুণ, ৮৭!
এবার একটু ভাবুন, প্রায় ৪৪ গড় আর প্রতি ১০০ বলে ৮৭ রান করা একজন ব্যাটারকে ওয়ানডে গ্রেট হিসেবে কিনা বিবেচনা করা হয় না। ‘ফ্যাভ ফোর’-এর মধ্যে তাকে রাখা হয়েছে সবসময়, তবে সেটা তার টেস্টের প্রায় অতিমানবীয় ব্যাটিংয়ের কারণেই। অথচ লম্বা এক ক্যারিয়ারে বারবার স্মিথ প্রমাণ দিয়েছেন, ওয়ানডে ক্রিকেটটাও তিনি বেশ ভালো খেলেন।
অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে ওয়ানডেতে স্মিথের চেয়ে বেশি গড় কেবল ডেভিড ওয়ার্নারের। এই ফরম্যাটে দেশটির ইতিহাসে তার চেয়ে বেশি রান মাত্র ১১ জনের। দুইবার হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার বর্ষসেরা ওয়ানডে ক্রিকেটার। বড় মঞ্চে রয়েছে দারুণ সব ম্যাচ জেতানো ইনিংস। এরপরও অস্ট্রেলিয়ার ওয়ানডের সর্বকালের সেরা দল করতে গেলে অধিকাংশই রাখবেন না স্মিথকে।
২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপের সময় স্মিথ ছিলেন ফর্মের তুঙ্গে। গ্রুপ পর্বে দুটি ফিফটির পর শেষ আটে পাকিস্তানের বিপক্ষে করেন আরেকটি ফিফটি। এরপর ভারতের বিপক্ষে সেমিফাইনালে খেলেন মাত্র ৯৩ বলে ১০৫ রানের ইনিংস। আর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ফাইনালে জয়সূচক বাউন্ডারি মারার পথে করেন আরেকটি ফিফটি।
সেই তুলনায় অস্ট্রেলিয়ার ২০২৩ বিশ্বকাপ জয়ে খুব বড় অবদান রাখতে পারেননি। তবে কয়েকটি ভালো ইনিংস খেলার পাশাপাশি প্যাট কামিন্সকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে সাহায্য করেন লিডারশিপ গ্রুপে থেকে। স্মিথের নেতৃত্ব গুণ সবসময়ই প্রশংসিত হয়েছে এই কারণেই, কারণ স্রেফ তার মাঠে থাকাটাও দলকে এনে দেয় বাড়তি কিছু।
অধিনায়ক হিসেবে ক্ষুরধার স্মিথ ২০১৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে মোট ৬৪ বার ওয়ানডেতে অধিনায়কত্ব করেছেন। শুধুমাত্র রিকি পন্টিং, অ্যালান বর্ডার, স্টিভ ওয়া, মার্ক টেলর এবং মাইকেল ক্লার্কই এই ফরম্যাটে তার চেয়ে বেশি ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার নেতৃত্ব দিয়েছেন। তবে তারা সবাই বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দিলেও স্মিথই সেটা পারেননি।
তবে খেলোয়াড় হিসেবে দুটি বিশ্বকাপ জেতাও তো কম নয়। বিশ্বের অনেক ক্রিকেটারই যে ক্যারিয়ার শেষ করেন একটি বিশ্বকাপ না জিতেই। নির্লিপ্ত স্মিথ তার অবসরের ঘোষণাতেও তাই আক্ষেপ লুকিয়ে জানিয়েছেন, ২০২৭ বিশ্বকাপে তরুণদের সুযোগ করে দিতেই তার সরে যাওয়া।
পুরো ক্যারিয়ার যেমন, স্মিথের অবসরের ঘোষণাও এসেছে ঠিক সেভাবেই। ইনস্টাগ্রামে পোস্ট দিয়ে জানিয়েছেন ৫০ ওভারের ক্রিকেটকে বিদায়। নিয়তিই যেন চায়নি, অধিনায়ক হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতে তিনি অবসর নেন। ফলে ‘আন্ডাররেটেড’ স্মিথের শেষটাও হয়েছে ঠিক সেভাবেই, যেভাবে এই ফরম্যাটে তার ব্যাটসম্যানশিপ থেকে গেছে আড়ালেই।
তবে ক্রিকেট ভক্তরা অস্ট্রেলিয়ার হলুদ জার্সিতে ৫০ ওভারের ক্রিকেটে স্মিথের লড়িয়ে সব ইনিংস যে মিস করবেন, তা না বললেও চলে। এটাও তো কম অর্জন নয় বৈকি!
১৫ জুন ২০২৫, ৫:৫১ পিএম
১৫ জুন ২০২৫, ৩:২৮ পিএম
১৪ জুন ২০২৫, ৭:২১ পিএম
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অভিজ্ঞ কোচ রিচার্ড পাইবাস বসুন্ধরা ক্রিকেট নেটওয়ার্কে যোগ দিয়েছেন ক্রিকেট ডেভেলপমেন্ট ও ট্রেনিং পরিচালকের ভূমিকায়। স্বল্পমেয়াদে দায়িত্ব নিয়ে ইংলিশ এই কোচ বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ তারকার সন্ধান করার জন্য কাজ করবেন তিনি।
পাইবাসের রয়েছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একাধিক দেশ এবং বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি দলের সঙ্গে কাজ করার বিশাল অভিজ্ঞতা। প্রশাসক হিসেবেও বেশ সুনাম রয়েছে তার। এবার বসুন্ধরা ক্রিকেট নেটওয়ার্কে কাজ করার জন্য বাংলাদেশে এসেছেন গত শনিবার।
এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বসুন্ধরা ক্রিকেট নেটওয়ার্কের জানিয়েছে,
“গেম ডেভেলপমেন্ট এবং ট্রেনিং ডিরেক্টর হিসেবে পাইবাসকে গর্বের সাথে স্বাগত জানাচ্ছে বসুন্ধরা ক্রিকেট নেটওয়ার্ক। একজন বিশ্বমানের স্বপ্নদ্রষ্টা এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে আধুনিক ক্রিকেট ইকোসিস্টেমের মাধ্যমে একটি নতুন ক্রিকেট বিপ্লব গড়ার লক্ষ্যে কাজ করবেন।”
পাইবাস নিয়োগ পেয়েছেন তিন মাসের জন্য। বিবৃতিতে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক প্রধান কোচ জানিয়েছেন তার পরিকল্পনার কথা। “এখানকার প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের সাথে দেখার সুযোগ পেয়ে আমি রোমাঞ্চিত। ভবিষ্যতের তারকাদের খুঁজে বের করাই হবে আমার প্রধান লক্ষ্য।”
২০১২ সালে পাইবাসকে বাংলাদেশ জাতীয় দলেরকোচ হিসেবে নিয়োগ দেয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) তার সাথে চুক্তি করেছিল ২ বছরের চুক্তি। কিছু সময়ের জন্য হাই পারফরম্যান্স প্রোগ্রামেও যুক্ত ছিলেন। তবে কয়েক মাস বাদেই তিনি পদত্যাগ করেন।
পাইবাসের কোচিং ক্যারিয়ার শুরু হয় দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনি ১৯৯৯ ও ২০০৩ সালে দুই মেয়াদে পাকিস্তান জাতীয় দলের প্রধান কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া পাইবাসের ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের ডিরেক্টর অব ক্রিকেট হিসেবেও কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। এছাড়া ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাতীয় দলের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান কোচ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের নতুন চক্র শুরুর আগেই বাতাসে ভাসছিল ভারত ক্রিকেট বোর্ডের ফাইনালের স্বাগতিক হওয়ার খবর। তবে সেটা আর হচ্ছে না বলেই দাবি যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ-এর। প্রথম তিন আসরের মত আগামী তিন আসরেও নাকি ইংল্যান্ডের মাটিতেই হতে যাচ্ছে শিরোপা লড়াই।
সম্প্রতি দ্য টেলিগ্রাফ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) এরই মধ্যে ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডকে (ইসিবি) মৌখিকভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, পরবর্তী তিন আসরের ফাইনালও আয়োজন করতে যাচ্ছে দেশটি।
আরও পড়ুন
‘কাঠুরে’ মার্করামের হাত ধরেই এল দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন সূর্যোদয় |
![]() |
২০২১ সালে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম ফাইনাল হয়েছিল সাউথ্যাম্পটনে। ২০২৩ সালে হয়েছিল দ্য ওভালে। আর সদ্য শেষ হওয়া তৃতীয় ফাইনালটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঐতিহাসিক লর্ডসে। তিন ফাইনালের একটিতেও ইংল্যান্ড না খেললেও প্রতিবারই গ্যালারি ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। আয়োজক হিসেবে ইংল্যান্ডের ধারাবাহিক সফল ব্যবস্থাপনা, আবহ ও দর্শদের অংশগ্রহণ ফাইনাল আয়োজনে ইংল্যান্ডকেই এগিয়ে রেখেছে।
২০২৫ থেকে ২০২৭ চক্রের ফাইনাল অবশ্য ভারতের ক্রিকেট বোর্ড নিজেদের দেশে আয়োজনের জোর আগ্রহই প্রকাশ করেছিল। তারা আহমেদাবাদ, কলকাতা ও মুম্বাইয়ের আধুনিক স্টেডিয়ামের ফাইনাল আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে আইসিসি বাণিজ্যিক মূল্যায়ন ও দর্শক সহজলভ্যতার ভিত্তিতে সেই প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছে।
সূত্রের বরাত দিয়ে দ্য টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, আইসিসির বার্ষিক সভায় আগামী জুলাইয়ে ফাইনালের স্বাগতিক দেশ নির্বাচনের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত হবে। আর সব ঠিক থাকলে ২০২৭, ২০২৯ এবং ২০৩১ সালের ফাইনালগুলোও ইংল্যান্ডের স্টেডিয়ামগুলোতেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
নীল আকাশের নীচে আমি, রাস্তা চলেছি একা… বাংলার কিংবদন্তি এই গান এইডেন মার্করামের শোনার কোনো কারণ নেই। যদি শুনে থাকতেন, তাহলে লর্ডসের ব্যালকনিতে ফেরার পথে গুনগুন করে নিশ্চয় এই গানটিই গাইতে চাইতেন তিনি। ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাস গড়া জয়ে যে তিনি একাই ছুটেছেন অমরত্বের পথে, যেখানে তার পেছনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল গোটা একটা জাতির দীর্ঘদিনের হাহাকার আর না পাওয়ার বেদনা।
রান তাড়ায় মার্করাম ১৩৬ রানে থাকা অবস্থায় জশ হ্যাজেলউডের ওভারেই হয়ত চেয়েছিলেন ম্যাচটা শেষ করে দিতে। তবে বাউন্ডারি হাঁকাতে গিয়ে ধরা পড়লেন ট্রাভিস হেডের হাতে। করতালির মাধ্যমে পুরো লর্ডস দাঁড়িয়ে গেল সম্মান জানাতে। অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়রা একে একে এগিয়ে আসলেন মার্করামের কাছে, যিনি ১৫ বছর পর তাদের স্বাদ দিয়েছেন ফাইনালে হারের ভুলে যাওয়া এক অভিজ্ঞতার। তবে আশেপাশের সবকিছু যেন তখন ধারন করতে পারছিলেন না দক্ষিণ আফ্রিকার এই স্টাইলিশ ব্যাটার। তিনি ব্যাটটাকে এমনভাবে কাঁধে নিয়ে নিলেন, যেন একজন কাঠুরে সদ্যই কেটে আসলেন এক শতবর্ষী বটগাছ। ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত এক চাহনিতে ফুটে উঠল অনেক না পাওয়া কষ্টের পূর্ণতা দেওয়ার অভিব্যক্তি।
আপনি যদি পুরো ম্যাচটা না দেখে কেবল মার্করামের আউট হওয়ার পরের চিত্রগুলো দেখেন লর্ডসের বিখ্যাত ড্রেসিংরুমে যাওয়া পর্যন্ত, মনে হতেই বাধ্য যে হয়ত দলকে বিপদে ফেলে বাজে এক শট খেলে তিনি উইকেট বিলিয়ে দিয়ে এসেছেন। নির্লিপ্ত, ধীরগতিতে এমনভাবে নিজেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন, যেন নিজের কাজটা ঠিকঠাক করতে পারেননি। আসলেই কি তাই?
মার্করাম তো তার আগে খেলে ফেলেছেন সম্ভবত দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা এক ইনিংস। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রেখেছিলেন অমিত সম্ভাবনা নিয়ে। অ-১৯ বিশ্বকাপ জয়ে নেতৃত্ব দিয়ে আভাস দিয়েছিলেন ভবিষ্যতে জাতীয় দলের অধিনায়ক হওয়ারও। তবে লর্ডসের ফাইনালের আগ পর্যন্ত ক্রিকেটার ও অধিনায়ক হিসেবে নিজের নামের প্রতি সেভাবে সুবিচর করতে পারেননি। দুই বার টেস্ট দল বাদ পড়েছিলেন ফর্মের কারণে। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের আগেও প্রশ্ন ছিল, মার্করাম কীভাবে দলে থাকে!
আরও পড়ুন
মার্করাম বীরত্বে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা দক্ষিণ আফ্রিকার |
![]() |
সেই মার্করামই যখন চতুর্থ দিনের ঝকঝকে সকালে আউট হলেন, তখন দক্ষিণ আফ্রিকা ইতিহাস গড়া থেকে কয়েক কদম দূরে। মূল কাজটা করার পর তিনি চেয়েছিলেন দলকে জিতিয়েই মাঠ ছাড়তে, সেটা না হওয়াতেই হয়ত সাজঘরের ফেরার পথে দেখা মেলেনি তার হাসি মুখের। নাকি এর সাথে মিশে আছে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটের যুগ যুগের চাপা কান্নাও?
১৯৯৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা যখন মিনি বিশ্বকাপ খ্যাত এখনকার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতে, তখন কে ভেবেছিলে যে পরের আইসিসি ইভেন্টে শিরোপা জিততে তাদের অপেক্ষা করতে হবে ২৭ বছরের? কে ভেবেছিল বৃষ্টি, ভাগ্য, ক্রিকেটের আইন সব দাঁড়িয়ে যাবে তাদের সাফল্য রুখে দিতে? কে ভেবেছিল দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বয়ে বেড়াতে হবে ‘চোকার্স’ নামের এক অনাকাঙ্ক্ষিত খেতাব? কেউই হয়ত নয়।
আর এই কারণেই বারবার শিরোপার খুব কাছে গিয়ে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেই বিখ্যাত টাই হওয়া সেমিফাইনাল থেকে শুরু করে ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের হার… মার্করাম শৈশব থেকে ক্রিকেটার হওয়ার পথচলায় সবই দেখেছেন মাঠের বাইরে ও মাঠে থেকে। তিনিও তাই ধারণ করেন কষ্টের সেই বোঝা, যা এতদিন চেপে ছিল গোটা দক্ষিণ আফ্রিকার কাঁধে। হয়ত এই কারণেই ফাইনালে ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুরি করে ব্যাটটা কাঁধে নিয়েছিলেন মার্করাম, পুরো জাতির বোঝা যে এই ইনিংসের প্রতিটি বলেই বয়ে বেরিয়েছেন তিনি।
অবশ্য বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই মার্করামের মাঝে এমন কিছুর সম্ভাবনা দেখা হচ্ছিল। একজন ক্ল্যাসিক্যাল ব্যাটার হওয়ার সব স্কিলই আছে তার। নতুন বল খেলার দক্ষতা, ইনিংস মেরামত করা, পাল্টা আক্রমণ করা বা বড় ইনিংস খেলা, সবই আছে তার মাঝে। তবে ক্রিকেটে আপনি কি করতে পারেন, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন আপনি কি করে দেখাতে পারছেন। আর এখানেই বারবার তিনি আটকে যাচ্ছিলেন একটি সীমার মাঝে। হয়ত এজন্যই যে, তিনি ক্যারিয়ার সেরা ইনিংসটা বরাদ্দ রেখেছেন দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফাইনালের জন্য।
আরও পড়ুন
অবশেষে দ.আফ্রিকার ‘চোকার্স’ ট্যাগ মুক্তির আনন্দ |
![]() |
অথচ প্রবল চাপ নিয়ে নামা সেই ফাইনালে প্রথম ইনিংসে রানের খাতাই খুলতে পারেননি তিনি। দ্বিতীয় ইনিংসে যখন ব্যাট করতে নামেন, ২৮২ রানের টার্গেটের সামনে দক্ষিণ আফ্রিকার আবার চোক করার সম্ভাবনা নিয়েই তখন আলোচনা ছিল বেশি। তবে ইনিংসের প্রথম ডেলিভারি থেকেই মার্করাম এমনভাবে ব্যাট চালানেন, যেন এই ইনিংসে তিনি যতক্ষন চাইবেন, ঠিক ততক্ষণই ব্যাট করে যেতে পারবেন।
আর শেষ পর্যন্ত হয়েছেও তাই। নির্ভুল এক ইনিংসে অস্ট্রেলিয়াকে সুযোগই দেননি কোনো। তৃতীয় উইকেটে পুরো ইনিংসে চোট নিয়ে খেলা টেম্বা বাভুমাকে সঙ্গ দেন ঢাল হয়ে। অধিনায়ককে সাহস যুগিয়েছেন চালিয়ে যেতে। হয়ত মার্করাম জানতেন, এই ফাইনালটা তাকে জেতার জন্যই খেলতে হবে। আর শিরোপা উঁচিয়ে ধরতে তিনিই হবেন কাণ্ডারি। হয়ত রি কারণেই এক বছর আগে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে অল্পের জন্য শিরোপার স্বাদ পাননি অধিনায়ক হিসেবে।
মাঠে থেকে শেষটা না করতে পারলেও মার্করাম কাজের কাজটা করে তবেই আউট হয়েছেন। এরপরও কেন মার্করামের আউট হয়ে ফেরার পথে অমন মিশ্র অনুভূতি? তৃপ্তির আনন্দ বোধহয় এমনই হয়। সময়টা তাই মার্করামের, সময়টা তাই দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটের জয়গান গাওয়ার, যা তাদের হাতে ধরা দিয়েছে সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত উৎস থেকে। যা পারেননি গ্রায়েম স্মিথ, হার্শেল গিবস, শন পোলক, এবি ডি ভিলিয়ার্স বা ডেল স্টেইন, তা কিনা ধরা দিল মার্করামের হাত ধরে! ক্রিকেট বা জীবন এভাবেই তো বারবার মিলিয়ে দেয় সব হিসাব-নিকাশ।
নিজের আন্তুর্জাতিক ক্যারিয়ার পরে দেখেছেন কাছ থেকে, আর আগে মাঠের বাইরে থেকেও সাক্ষী জাতীয় দলের একের পর এক হতাশার গল্পের। বারবার শিরোপার খুব কাছে গিয়ে খালি হাতে ফেরার তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়েই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে নেমেছিল দক্ষিন আফ্রিকা। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই লড়াইয়ে বারদুয়েক হোঁচট খেলেও শেষ পর্যন্ত বিজয়ীর বেশেই মাঠ ছেড়েছে টেম্বা বাভুমার দল। প্রোটিয়াস অধিনায়ক মনে করেন, এবার ভাগ্য তাদের সহায় হয়েছিল বলেই মিলেছে সাফল্য।
সেই ১৯৯৮ সালে মিনি বিশ্বকাপ (বর্তমানে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি) জিতেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। এরপর থেকে ২৭ বছরে দলটি আইসিসি ইভেন্টে সেমিফাইনাল-ফাইনাল খেলেছে এর আগে ২০ বার। প্রতিবারই তুমুল সম্ভাবনা জাগিয়েও তারা পারেনি শেষ হাসি হাসতে। এবার টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে এসেছিল টানা সাত ম্যাচ জিতে। এরপরও ছিল শঙ্কা। তবে সেটা উড়িয়ে দিয়ে ৫ উইকেটের জয়ে শিরোপা খরা কেটেছে দক্ষিণ আফ্রিকার।
আরও পড়ুন
যোগ্য দল হিসেবেই জিতেছে বাভুমারা, মানছেন কামিন্স |
![]() |
রান তাড়ায় চোট নিয়ে দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলা বাভুমা ম্যাচের পর জানালেন উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া।
“শেষ কয়েকটা দিন ছিল অসাধারণ। কিছু কিছু সময়ে তো মনে হচ্ছিল আমরা যেন দক্ষিণ আফ্রিকাতেই খেলছি। আমরা কঠোর প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, জয়ের বিশ্বাস নিয়ে এখানে এসেছিলাম। যদিও অনেকেই আমাদের নিয়ে সন্দিহান ছিল। ভালো খেলতে পেরে অনেক ভালো লাগছে। আমরা বারবার সাফল্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছেছি, আবার হতাশাও পেয়েছি। এবার সৌভাগ্য আমাদের সাথে ছিল। আশা করি এই জয় দিয়ে আরও অনেক কিছুর সূচনা হতে যাচ্ছে।”
ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার জয়ে সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন পেসার কাগিসো রাবাদা ও ওপেনার এইডেন মার্করাম। দুই ইনিংস মিলিয়ে ৯ উইকেট নেওয়া রাবাদা দাঁড়াতেই দেননি অস্ট্রেলিয়ার টপ অর্ডারকে। আর প্রথম ইনিংসে ডাক মারা মার্করাম রান তাড়ায় উপহার দেন ১৩৬ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস, যা তার ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস বললেও কমই বলা হবে।
আরও পড়ুন
অবশেষে দ.আফ্রিকার ‘চোকার্স’ ট্যাগ মুক্তির আনন্দ |
![]() |
দুজনের জন্যই বাড়তি প্রশংসা বরাদ্দ বাভুমার।
“কাগিসো রাবাদা আমাদের এই দলের বড় শক্তি। কয়েক দিন আগে আমি 'হল অব ফেম'-এর নতুন সদস্যদের তালিকা দেখছিলাম। আমার বিশ্বাস, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে তার নামও সেখানে চলে যাবে। আর এইডেন মার্করামও অসাধারণ ছিল। দলে তার জায়গা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু তার যে মানসিক দৃঢ়তা আছে, সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। রাবাদা আর এইডেন দুজনেই দলের হার না মানা মানসিকতার প্রতিনিধিত্ব করেছে।”
বারবার হতাশ হওয়া দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য দেশ হিসেবে জয়ের মাহাত্ব কেমন, সেটাও অনুধাবন করতে পারছেন বাভুমা।
“যত বিভক্তই হই না কেন, এটা আমাদের জন্য, আমাদের গোটা জাতির জন্য একটা সুযোগ এক হওয়ার। এই ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন যে আমরা সবাই একসাথে মিলেমিশেই এই সাফল্য উদযাপন করব।”
আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের আগের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া এবারের ফাইনালেও নেমেছিল ফেভারিট হিসেবে। প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা অনেকটা চমক দেখিয়েই টানা সাত ম্যাচ জিতে শিরোপার লড়াইয়ে জায়গা করে নিলেও, তাদের ফেভারিট হিসেবে কেউই সেভাবে রাখতে চাননি। তবে চারদিনের লড়াইয়ের পর টেম্বা বাভুমার দলই মাঠ ছেড়েছে বিজয়ীর বেশে। অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক প্যাট কামিন্স মনে করেন, যোগ্য দল হিসেবেই জিতেছে তাদের প্রতিপক্ষ।
ফাইনালের প্রথম দিনেই অনেকটা ব্যাকফুটে চলে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। মাত্র ২১২ রানে গুটিয়ে যাওয়ার পরও অবশ্য টিকিয়ে রাখেন বোলাররা। দক্ষিণ আফ্রিকা অলআউট হয় ১৩৮ রানেই। দ্বিতীয় ইনিংসেও ব্যাটাররা সেভাবে বড় স্কোর না করলেও টার্গেট দাঁড় করাতে সক্ষম হয় ২৮২ রানের, যা বেশ চ্যালেঞ্জিং। তবে শেষ পর্যন্ত ৫ উইকেটে হেরে টানা দ্বিতীয়বার এই প্রতিযোগিতার শিরোপা আর জেতা হয়নি অস্ট্রেলিয়ার।
আরও পড়ুন
অবশেষে দ.আফ্রিকার ‘চোকার্স’ ট্যাগ মুক্তির আনন্দ |
![]() |
অধিনায়ক কামিন্স মনে করেন, নিজেদের সেরাটা দিতে পারেননি তারা দল হিসেবে।
“পরিস্থিতি খুব দ্রুত বদলে যেতে পারত, কিন্তু আমাদের জন্য এবার কাজটা একটু বেশিই কঠিন ছিল। কিছু জায়গায় আমরা ঠিকভাবে খেলতে পারিনি। প্রথম ইনিংসে ভালো লিড নিয়েও আমরা প্রতিপক্ষকে পুরোপুরিভাবে চাপে রাখতে পারিনি। (রান তাড়ায়) দক্ষিণ আফ্রিকা চতুর্থ ইনিংসে আমাদের কোনো সুযোগই দেয়নি। এইডেন (মার্করাম) আর টেম্বা (বাভুমা) আমাদের কোনো সুযোগ দেয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকা দেখিয়ে দিয়েছে যে কেন তারা এই মঞ্চে এসেছে, আর যোগ্য দল হিসেবেই তারা জিতেছে।”
দুই ইনিংসেই অস্ট্রেলিয়াকে ভুগিয়েছে টপ অর্ডার। দ্বিতীয় ইনিংসে ভালো একটা লিড নেওয়ার পর সুযোগ ছিল বড় টার্গেট ছুঁড়ে দেওয়ার। তবে মাত্র ৭৩ রানেই ৭ উইকেট হারিয়ে প্রবল চাপে পড়ে যায় দলটি। সেখান থেকে টেল এন্ডারদের সহায়তায় একটা ভালো লক্ষ্যই দক্ষিণ আফ্রিকাকে দিয়েছিল অজিরা। তবে এইডেন মার্করামের সেঞ্চুরি ও টেম্বা বাভুমার ফিফটিতে অনায়াসেই জয় পেয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা।
এই হারের জন্য কামিন্স অবশ্য ব্যাটারদের দায় দিতে নারাজ।
“আমাদের ব্যাটিং লাইনআপ নিয়ে কিছু চিন্তা আছে। তবে গত দুই বছরে তাদের অনেকেই ভালো করেছে। বোলাররা প্রথম দুই দিন বেশ ভালো করেছে। আমরা সবকিছুই দিয়েই চেষ্টা করে গেছি। নাথান লায়ন দুর্দান্ত বোলিং করেছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে উইকেট পায়নি। ফাইনালে ওঠাও একটা বিশাল অর্জন। এক ম্যাচের শিরোপা নির্ধারণী লড়াই দারুণ রোমাঞ্চকর। যদিও ফলটা আমাদের পক্ষে আসেনি, তবুও একটা অসাধারণ সপ্তাহ কাটল।”
১ দিন আগে
২০ দিন আগে
২৫ দিন আগে
২৭ দিন আগে
২৭ দিন আগে
২৭ দিন আগে
২৭ দিন আগে