ম্যাচ শেষে দাঁড়িয়ে আছি স্টেডিয়ামের বাইরে। স্পেন কিছুক্ষণ আগে ৭ গোল দিয়েছে কোস্টারিকার জালে। কাতার বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় জয়, ইতিহাসেরও অন্যতম। সব সেট করে দাঁড়িয়ে আছি প্রোডিউসারের কলের অপেক্ষায়। খানিকটা দূর থেকে খুব সাধারণ প্রশ্ন এলো প্রায় নিত্য দিনকার মতোই,- “টি স্পোর্টস? ফ্রম হোয়ের?”
জবাব দিলাম, বাংলাদেশ। আমার এক কানে হেড ফোন, তাতে টি স্পোর্টসের লাইভ কাভারেজ শুনছি। মনোযোগও সেদিকেই। কিন্তু এর মাঝেও স্পষ্টই শুনতে পেলাম- প্রশ্নকর্তা একটা রিমার্ক রেখে গেলেন। চিৎকার করে একটা কথাই বললেন, সাকিব আল হাসান।
হাত নাড়িয়ে সম্ভাষণ জানালাম, ক্লান্তিও উবে গেল নিমিষেই। কিন্তু কার উদ্দেশ্যে হাত নাড়লাম তাও জানিনা।
সহজেই বুঝতে পারলাম, বাংলাদেশ নামের প্রতিশব্দ তাঁর কাছে ক্রিকেটার সাকিব। হয়ত তাঁর মতো আরও কোটি-কোটি মানুষের কাছেও তাই।
আলোর ঝলকানিতে ভদ্রলোকের চেহারা মনে নাই। সাকিবের নামের শব্দচয়ন ভঙ্গি শুনে যতটুকু ধারণা করতে পারি তিনি হয়ত উপমহাদেশের কেউ হবেন। হয়ত উপমহাদেশ ছাড়িয়ে অন্য কোথাকার। তবে সহসা যেটা অনুমান করে নেওয়া যায় ; তিনি হয়ত স্পেনের কেউ হবেন না, কোস্টারিকার কেউ হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। অনুমানের ব্যপ্তি খাটো করলে বুঝতে পারি নিশ্চয়ই ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের কেউই হবেন। এখন ক্রিকেট তো নেদারল্যান্ডসও খেলে। সেখানকার কোনো একজন তো হতে পারেন? তবে যে দেশে ক্রিকেটের পেশাদার কাঠামো অনুপস্থিত সেখানকার কেউ জিওগ্রাফির সঙ্গে একজন ক্রিকেটারকে পরিচায়ক হিসেবে মেনে নেবেন- সেই সুযোগ বেশ কম!
সাকিব বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছেন, ঠিক ততোটুকুর ভেতরই যতটুকুর গন্ডি ক্রিকেটের আছে। এর বাইরে যাওয়ার সাধ্য যেখানে ক্রিকেটেরই হয় না, সেখানে একজন ক্রিকেটারের হবে কী করে?
সন্দেহাতীত ভাবে সাকিব আল হাসানই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সুপারস্টার। কারণ এখানে ক্রিকেটটা বড়। কারণ, সাকিব এই আলো বাতাসে বেড়ে উঠেছেন, এই কাদায় হেটেছেন, এই ধুলো মাড়িয়েছেন, নিজেদের মেধা দিয়ে এই দেশের এক্সিসটিং ‘বিশ্ব থেকে যোজন পিছিয়ে থাক প্রায় অকেজো একটা সিস্টেমের’ ভেতর দিয়েও তিনি ক্রিকেটে নিজেকে বিশ্বের সেরায় পরিণত করতে পেরেছিলেন।
ব্যস এইটুকুই যথেষ্ট। ঠিক এই জায়গাতেই হামজা চৌধুরীর চেয়ে এ দেশের লোকেদের কাছে এগিয়ে থাকবেন সাকিব। আর হামজা বেড়ে উঠেছেন পৃথিবীর সবচেয়ে নামকরা ফুটবল ইন্সিটিটিশনগুলোর একটা থেকে। ক্রিকেটের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই বলইলেই চলে, তবে এটুকু বুঝি বাংলাদেশ থেকে সাকিবের সাকিব হওয়ার ১% এর বেশি সম্ভাবনা সম্ভবত ছিল না। বাকি ৯৯ শতাংশ নিজ গুণে পেরেছেন বলেই তিনি সাকিব হয়েছেন।
তবে কোনো কিছুই স্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। ছোটবেলায় হামজাও ছুটিতে দেশে এসেছেন, বিয়ানিবাজারের মাঠে তার বাংলাদেশি বন্ধুদের সঙ্গে বলে লাথিটা মেরেছিলেন বলেই র্যা ঙ্কিং-এর ১৮৫ তম দেশের হয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। টেলিভিশনে তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেটটাও দেখেছেন, সাকিবকে ১৯ বিশ্বকাপে অতিমানব হতে দেখে নিশ্চয়ই ভেবেছেন, দেশটায় আর যাই হোক খেলার আবেগের অভাব নাই।
*
লিওনেল মেসির কৈশোরটাই কেটেছে আর্জেন্টিনার বাইরে। একটা সময় নিজ দেশের লোকেরাই তাকে আপন করতে পারেননি। অপরিসীম ভালোবাসার সঙ্গে মেসি গাল মন্দও শুনেছেন,। দিয়েগো মারাদোনা বহু অকাজ-কুকাজ করেও মারাদোনাই রয়ে গেছেন। মেসি তাঁর সমান হবেন না কোনোদিন। তাতে মেসির হাত কই? বার্সেলোনা ত্রাতা না হলে এই মেসি কি আর মেসি হন? মারাদোনা বহু আগেই ওখানে ইশ্বর হয়ে গেছেন, সবার গল্প এক ছাঁচে পড়ে না। তবে সবাই এক ছাদের নিচের থাকতে পারেন।
ডুয়েট ইয়র্ক, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর ফুটবলার। ব্রায়ান লারা, একই দেশের ক্রিকেটার। একজন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের চ্যাম্পিয়নস লিগ উইনার, আরেকজন- লারা তো লারা। এদের ভেতর কে বেশি জনপ্রিয়? এই নিয়ে ত্রিনিদাদে আলোচনা হয়। হামজা না সাকিব- কার তারকাখ্যাতি কতো বেশি এই নিয়ে দর্শক- সমর্থকদের আলোচনার আগ্রহ না থাকাটাই বরং অস্বাভাবিক। এই আলোচনা থাকবে, এবং এই আলোচনায় বাইনারি এবং নন-বাইনারি দুই মতই থাকতে পারে। দুই পক্ষেই থাকতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে কেন থাকতে পারে? জবাবটাও সহজ, ফুটবলের ব্যপ্তির কারণে।
জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে প্রিমিয়ার লিগের সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে ধারাবাহিক জনপ্রিয় স্পোর্টিং ইভেন্ট। গেল কয়েক দশক ধরেই পৃথিবীর ট্রেন্ডটা এমন। টাকাই সব, টাকার অঙ্কে এই লিগের ধারে কাছেও আসে না কিছু। জার্মানি-ইতালির টপ ফুটবলার, কোচরা প্রিমিয়ার লিগের মিড টেবিল টিমে নাম লিখিয়ে ফেলেন অনায়াসেই। বেতনের সঙ্গে, ব্র্যান্ড ভ্যালুটাও ভালো। গোটা এশিয়া থেকে কয়জনের সুযোগ হয় সেই লিগে? এশিয়ার ম্যাপটায় চোখ বুলিয়ে ফেলতে পারেন, উপমহাদেশটাইকেই ছোট মনে হচ্ছে না? এতো বড় এশিয়া থেক এতোদিন মোটে ৫টা মহা সৌভাগ্যবান দেশের সুযোগ হয়েছে বিশ্বকাপ খেলার। সামনে সংখ্যাটা বাড়ছে আরও। এরা সবাই ফুটবল খেলে, দু একটা দেশ বাদ দিলে সবাই পেশাদার ফুটবল খেলে। এই প্রতিযোগিতার মাপকাঠি অন্য কিছুর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার উপায় থাকে?
প্রায় শূন্য টাকা খরচা করে একজন এফএ কাপ উইনারের স্বেচ্ছায় বাংলাদেশের জার্সি গায়ে চাপানোর গভীরতা বুঝতে পারা কি এতোই কঠিন? চিন্তা-ভাবনার সীমানা প্রাচীর বেঁধে দিলে অবশ্য সবই কঠিন।
প্রিমিয়ার লিগের একটা ফুটবল ম্যাচে ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, অ্যারাবিক, বাংলা- সহ আরও কত ভাষায় সপ্তাহান্তে ধারাবাহিকিভাবে ধারাভাষ্য হয়। এই তো মাস দুই আগের ঘটনা- লেস্টার সিটির ম্যাচে বিইন স্পোর্টসের অ্যারাবিক কমেন্টেটর হামজার পায়ে যতবার বল যাচ্ছে ঠিক ততোবারই ‘ইয়া বাঙালি, ইয়া বাঙালি’ বলে গলা ফাটালেন; এর গভীরতা বোঝা খুব কঠিন?
মধ্যপ্রাচ্যের স্থানীয় লোকেরা ক্রিকেটটা চেনেন না। বাংলাদেশ শব্দটা শুনলে তাদের মাথায় চট করে কী খেলে যাওয়া উচিত? কোনো ক্রিকেটারের নাম কি? নিশ্চয়ই নয়? হয়ত আপনার আমার মতো তামাটে বা কালচে রঙের খেটে খাওয়া কারও ছবিই তাঁদের চোখে ভাসে। এক হামজা যে কেবল বাংলাদেশের জার্সি গায়ে চাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েই ‘কামলা’ থেকে আপনার আমার ইমেইজ ‘আপগ্রেড’ করে দেওয়ার কাজ শুরু করে দিলেন, তা বুঝতে মেধা খরচ করতে হয়?
আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জেতার পর ফিফার এক রিপোর্টার বাংলাদেশের এক সুপারস্টারের ইন্টারভিউ করতে চেয়েছিলেন। তাকে সাকিব আল হাসানের সন্ধানই দিয়েছিলাম। সাকিব নিজেও রাজি হয়েছিলেন, এরপর যে কোনো কারণেই হোক সাকিবের সেই কাজটা আর আগায়নি। ফিফা হামজার ইন্টারভিউও করবে, আজ হোক কাল হোক করবে, সে জন্য আমার কাছে আসতে হবে না, বরং আমারই ধর্ন্যা দেওয়া লাগবে ফিফার কাছে।
সুপারস্টার বলতে আপনি কী বোঝেন? আপনি যা বোঝেন আমিও তাই বুঝি। তবে সেই সংজ্ঞা ক্ষেত্র বিশেষে পালটে যেতেই পারে। বৈশ্বিক সুপারস্টার এই দুইজনের সম্ভবত কেউ নন। একজন থাকলে সেটা সম্ভবত বাংলাদেশের অন্তবর্তী সরকারের প্রধান। যিনি এক ফোনকলে মেসিকে খুঁজতে পারেন, রোনালদোকেও চাইতে পারেন। বাকি দুইজনের পক্ষে সে প্রায় অসম্ভব।
সুপারস্টার আপাত দৃষ্টিতে খুব সহজ শব্দ মনে হয়। কিন্তু এর ভেতর ভাগ আছে অনেক। এরকম একটা জিনিস নিয়ে তর্ক হবে না? না হওয়াটাই তো অস্বাভাবিক!