২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭:০২ পিএম
কানপুর টেস্টে দ্বিতীয় দিনের খেলা একটি বলও না হওয়া ছাড়াই পরিত্যাক্ত হওয়ায় বাংলাদেশ-ভারত টেস্ট হয়ত এগিয়ে যাচ্ছে ড্রয়ের দিকেই। ফলে খুব বিশেষ কিছু না ঘটলে সাকিব আল হাসানের ক্যারিয়ারের সম্ভাব্য শেষ টেস্ট ম্যাচে তাকে হয়ত খুব বেশি ব্যাটিং বা বোলিংয়ে দেখার সুযোগ মিলবে না। আর তাই এই ফরম্যাটে তিনি কতোটা কার্যকর ছিলেন বাংলাদেশ দলের জন্য, সেই আলোচনা করা যেতেই পারে।
শুরুতেই সাকিবের টেস্ট পরিসংখ্যান একটু দেখা যাক। ৭০ ম্যাচে ৩৮.৩৩ গড়ে ৪ হাজার ৬০০ রান করেছেন ব্যাট হাতে। আর বোলার সাকিব নিয়েছেন ২৪২ উইকেট। ক্রিকেট ইতিহাসে এই ফরম্যাটে অলরাউন্ডারদের মধ্যে এত সমৃদ্ধ পরিসংখ্যান খুব বেশি ক্রিকেটারের নেই।
টেস্ট ক্রিকেটে সাকিবের অভিষেক ২০০৭ সালে, চট্টগ্রামে ভারতের বিপক্ষে। বয়সভিত্তিক দল থেকে অলরাউন্ডার হিসেবে পারফর্ম এর আগের বছরই খেলেছেন প্রথম ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি। ফলে লাল বলের ক্রিকেটে প্রথম ম্যাচের আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সাথে কিছুটা পরিচিতি ছিল তার। ভারতের বিপক্ষে সেই ম্যাচে ছয় নম্বরে নেমে এক ইনিংস ব্যাট করার সুযোগ পেয়ে করেছিলেন ২৭ রান। বল হাতে দুই ইনিংস মিলিয়ে পাননি উইকেট।
তবে মোহাম্মদ রফিকের অবসরের সময় হয়ে যাওয়া, এনামুল হক জুনিয়রের সেরা ছন্দে না থাকা মিলিয়ে স্পেশালিষ্ট বোলার হিসেবেই টেস্টে সাকিবকে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে বেশ কিছুটা ম্যাচে খেলায় বাংলাদেশ। খালি চোখে দেখলে তার বাঁহাতি স্পিনে নেই বিশেষ কিছু। ঝুলিতে অস্ত্রও বেশ কম। তবে গেম সেন্স প্রখর হওয়া এবং মাথা খাটিয়ে বোলিং করার গুণের কারণে ম্যাচের পর ম্যাচ দলের প্রথম ও একমাত্র স্পিনার হিসেবে খেলে গেছেন সাকিব মূলত স্পিনার হিসেবে। পেয়েছেন দারুণ কিছু সাফল্য।
যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাটিতে সিরিজে কিউই বাঁহাতি স্পিনার ড্যানিয়েল ভেট্টরির সাথে পাল্লা দিয়ে ব্যাটে-বলে পারফর্ম করা। আরও ছিল ২০০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে দলটির বিপক্ষে দুটি ফাইফার। দক্ষিণ আফ্রিকার পেস সহায়ক উইকেটে দুই ম্যাচে দুইবার পাঁচ বা তার বেশি উইকেট নেওয়াটা বলে দেয়, স্পিনার হিসেবে যথেষ্ট কার্যকরই ছিলেন সেই সময়ে।
সেই সময়টাতে ব্যাটিংয়েও কিছু ভালো ইনিংস ছিল সাকিবের, তবে বোলিংয়ের তুলনায় সেটা বেশি ভালো ছিল বলায় যায়নি। ক্রমেই ব্যাটিং অর্ডারে উন্নতি করে এরপর পাঁচ-ছয়ে স্থায়ী হওয়া শুরু করেন। অলরাউন্ডার সাকিবের ব্রেকথ্রু সিরিজ বলা যেতে পারে ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইডিজ সফরকে। অধিনায়ক হিসেবে খেলা সেই দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে জেতান সিরিজ।
চার ইনিংস বোলিং করে ১৩টি উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি ব্যাট হাতে রান তাড়ায় খেলেন অপরাজিত ৯৬ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। সিরিজ সেরাও হন সেবার সাকিব। অলরাউন্ডার সাকিব এরপর থেকে লাল বলের ক্রিকেটেও বাংলাদেশের দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন।
রফিকের অবসরের পর থেকে শুরু করে তাইজুল ইসলামের আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত একাই টেস্টে বাংলাদেশের মূল স্পিনারের কাজ চালিয়ে গেছেন সাকিব। তাইজুল আসার পরও তিনিই থেকেছেন প্রথম স্পিন পছন্দ। দেশের মাটিতে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের ইতিহাস গড়া দুটি টেস্ট জয়ে বোলার সাকিব ছিলেন বেশ উজ্জ্বল।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের জেতা ম্যাচে দুই ইনিংস ৫ উইকেট নেন সাকিব। আর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়ের ম্যাচে তো বল হাতে একাই গড়ে দেন ব্যবধান। দুই ইনিংসেই পাঁচ উইকেট নিয়ে ধসিয়ে দেন অজিদের ব্যাটিং লাইনআপ। যদিও মেহেদি হাসান মিরাজ ইংল্যান্ড সিরিজে কেড়ে নেন সব আলো। তাইজুলও তত দিনে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন বেশ।
তবে বোলার সাকিবের বিশেষত্ব এখানেই যে, এই দুজন দলে আসার পরও বোলার হিসেবে দলে তার গুরুত্ব কমেনি সেভাবে। কিছুটা চাপ কমেছে, তবে একটা ব্রেকথ্রু এনে দেওয়ার জন্য অধিনায়কের প্রথম পছন্দ ছিলেন সাকিবই। দেশের মাটিতে ২০২২ সাল পর্যন্ত টেস্টে একাদশে বাড়তি এক বা দুই স্পিনার থাকলেও সাকিব ছিলেন বোলিং আক্রমণের আস্থার জায়গা। যদিও, কার্যকারিতা অনেকটাই যায় কমে। মিরাজ ও তাইজুল নিয়ে নেন প্রথম দুই স্পিনারের অবস্থান। সাকিবের কাজ হয় দলের দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্পিনারের ভূমিকা পালনের।
তবে গত দুই বছরে, বিশেষ করে এই বছর বোলার সাকিবের ধার আরও কমে গেছে। একেবারে সাম্প্রতিক সময় যদি ধরা হয়, পাকিস্তানের বিপক্ষে এক ইনিংস বাদ দিলে ভারত সিরিজ পর্যন্ত বাকি পাঁচ ইনিংসে সাকিব একেবারেই সাদামাটা বোলিং করেছেন। আঙ্গুলের চোটও নাকি ভোগাচ্ছে বেশ। সাথে আছে কাঁধে ব্যাথা। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হল, ভারত সিরিজের আগে কাউন্টিতে সারের হয়ে এক ম্যাচে প্রায় ৬৪ ওভার বোলিং করে সাকিব নেন ৯ উইকেট। অথচ ভারতের বিপক্ষে সেই একই বোলার ২১ ওভার বোলিং করতে পেরেছেন, ৬ রানের বেশি ওভারে গুনে একটি উইকেটও। তার নির্বিষ বোলিং প্রতিপক্ষকে সুযোগ করে দেয় সহজে রান বের করার।
সাকিবের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হল, বল হাতে খারাপ করলে একই সময়ে তিনি জ্বলে উঠেছেন ব্যাট হাতে। তবে মাঠে ও মাঠের বাইরে নানা কাণ্ডে কঠিন সময়ে এবার সেটাও হচ্ছে না। টেস্টে সাকিবের শেষ সেঞ্চুরিটি এসেছে সেই ২০১৭ সালে। পাঁচ থেকে ছয় নম্বরে নামা একজন ব্যাটারের জন্য বিষয়টি চোখে পড়ার মত। এটাও ঠিক, বেশ কয়েকবার ৭০-৮০ রানের ইনিংসের অকাল মৃত্যু ঘটেছে সাকিবের খামখেয়ালিপানা শটে। তবে সেই ব্যর্থতায়ও তো তারই। দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যাটারদের একজন হয়েও সাকিব অসংখ্য ম্যাচে বাজে শটে উইকেট স্রেফ উপহার দিয়ে এসেছেন।
অবশ্য ব্যাটার সাকিবের টেস্ট ক্যারিয়ারটাও একই। ব্যাটিং বিপর্যয়ে নেমে খেলেছেন আগ্রাসী মেজাজে, আবার সেট হয়েও ব্যাখাতীত শটে আউট হওয়ার নজিরও কম নয়। ফলে যা হয়েছে, সাকিব ১০ রানে থাকুন বা ৭০-৮০ রানে, তিনি বড় ইনিংস খেলবেন বলে আস্থা রাখাটা ছিল ভীষণ কঠিন কাজ। আর সেই কারণেই ৩১ ফিফটির বিপরীতে সেঞ্চুরির সংখ্যা মাত্র পাঁচ।
তবে হাতে খুব সীমিত কিছু শট নিয়েও ব্যাটার সাকিবের যে রেকর্ড, সেটা একজন স্পেশালিষ্ট ব্যাটারও বর্তে যাবেন। অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তো বটেই। কার্যকারিতার বিচারে বোলার সাকিবের কাছে ব্যাটার সাকিব হয়ত কিছুটা পিছিয়েই থাকবেন। তবে বাংলাদেশের সেরা কিছু জয়ে ব্যাট হাতে তার যে অবদান, সেটাও বিশেষ কিছুই।
ব্যাট হাতে ক্রিজে ব্যস্ত ও অস্থির সাকিবের সেরা ইনিংস কোনটি? অনেকের কাছেই ২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তার করা সেই বিখ্যাত ডাবল সেঞ্চুরি। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে প্রতিপক্ষের সেরা পেসারদের সামলে যে পরিস্থিতিতে বিরুদ্ধ কন্ডিশনে সাকিব খেলেন ২১৭ রানের এক ইনিংস, সেটা অনেকের জন্যই স্বপ্নের ব্যাপার। ওই একটি ইনিংস দেখলে আপনার আফসোসও বাড়বে। কারণ, অমন ইনিংস যিনি খেলতে পারেন, তার মাত্র পাঁচটি সেঞ্চুরি নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করাটা রীতিমত অন্যায়।
তবে সাকিবের সেই সেঞ্চুরির পরও বাংলাদেশ ম্যাচটি হেরে যাওয়ায়া সাকিবের সেরা ইনিংসের বিবেচনায় আসতে পারে অন্য আরেকটি ম্যাচ। সেটি ছিল ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। মিরপুরের স্পিন সহায়ক এবং ভীষণ কঠিন এক উইকেটে সাকিব খেলেছিলেন ৮৪ রানের এক ইনিংস, দুই দল মিলিয়েই যা ছিল ম্যাচের সর্বোচ্চ। ওই ম্যাচটি যে উইকেটে খেলা হয়েছিল, সেখানে রান করাটা ছিল ভীষণ দুরূহ এক কাজ। সেটার পাশাপাশি সেই ম্যাচে বাংলাদেশ জিতে যাওয়ায় ইনিংসটিকে তার সেরা বলা যেতেই পারে।
আর অলরাউন্ডার সাকিবের সেরা ম্যাচ? তর্কসাপেক্ষে এটিও হয়ত অজিদের হারানোর সেই ম্যাচটি। কারণ, প্রথম ইনিংসে মহাগুরুত্বপূর্ণ ৮৪ রান করার পর বল হাতে ১০ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার অস্ট্রেলিয়াকে টেস্টে হারানোয় সবচেয়ে বড় ভূমিকা। আর এটা সবারই জানা, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুর্দান্ত কীর্তি দেখানোকে এখনও ধরা হয় একজন ক্রিকেটারের ব্যক্তিগত অর্জনের চূড়া।
অলরাউন্ডার সাকিব চূড়ায় উঠেছেন বারবার, হয়েছেন প্রথম ও একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে টেস্ট অলরাউন্ডার র্যাংকিংয়ের সেরা। ক্যারিয়ারের এই পড়ন্ত বেলায়ও আছেন তৃতীয় স্থানে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটার আর স্পিন অলরাউন্ডার হওয়ার কারণেই হয়ত সাকিবকে নিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে যতোটা মাতামাতি হওয়া প্রয়োজন, তা হয়নি আর। দলের বাজে ফলাফলও এতে রেখেছে ভূমিকা। তবে সাবেক ভারত ব্যাটার আকাশ চোপড়া সাকিবকে নিয়ে একবার যা বলেছেন, সেটা অলরাউন্ডার সাকিবের বিশালতাই তুলে ধরে। আকাশের চোখে সাকিব হলে ‘ড্যাডি অব অল অলরাউন্ডার’।
তো এমন একজন অলরাউন্ডার, যিনি ১৭ বছর ধরে টেস্টে দুইজন ক্রিকেটারের কাজ করে দিয়েছেন, তার শূন্যস্থান পূরণ করাটা প্রায় অসম্ভব কাজই হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের জন্য। দক্ষিণ আফ্রিকা যেমন আজও পায়নি জ্যাক ক্যালিসের উত্তরসূরি।
তাই অলরাউন্ডার সাকিব বাংলাদেশ দলের জন্য ঠিক কতোটা গুরুত্বপূর্ণ, সেই প্রশ্নের উত্তর হয়ত মিলবে তার বিদায়ের পরই।