৩০ জুন ২০২৪, ১:২২ পিএম
ইউটিউবে জনপ্রিয় একটি চ্যানেল আছে, স্ক্রিন পাত্তি নামে। নানা ধরণের কন্টেন্টে তাদের জনপ্রিয়তা এই মুহূর্তে ভারতের তুঙ্গে। তাদের আবার বিশেষ বিশেষ সেলেব্রিটিদের নিয়ে রয়েছে আলাদা আয়োজনও। সেখানেই জনপ্রিয় একটি চরিত্র হার্দিক পান্ডিয়াও। তার চরিত্রে তিনি অভিনয় করেন, চেহারা, উচ্চতা, মেকাপের পাশাপাশি কথা বলার ধরণের হুট করে দেখলে প্রায়ই আপনার তাকেই আসল হার্দিক বলেই মনে হবে। এই চরিত্রের মূল কাজ একটা ফোন নিয়ে নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে প্রাসঙ্গিক ভ্লগ করা। সবটাই মজার হলেও সেখানে ফুটে ওঠে কিছু নির্মম বাস্তবতাও। এই যেমন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) চলাকালীন সময়ের একটি পর্ব। মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের অধিনায়কত্ব নিয়ে হার্দিক যখন পুরো ভারতের সমালোচনার পাত্র, তখনকার পর্বে এক জায়গায় দেখা যায়, টিম মিটিং করতে হার্দিক যেতে চাচ্ছেন রোহিত শর্মার রুমে। এরপর একজন সতীর্থ তাকে মনে করিয়ে দেন, এখন তো হার্দিকই অধিনায়ক। এরপর তার সম্ভিত ফেরে। আরে, আমিই তো অধিনায়ক!
গত আইপিএলে হার্দিকের ওপর দিয়ে কী ঝড়টা গেছে, তা বোঝাতে এই একটি দৃশ্যই যথেষ্ট। মুম্বাইয়ে খেলে লাইমলাইটে আসার পর গুজরাট টাইটান্সে যান অধিনায়ক হয়ে। একটি শিরোপা সহ দুই আসরে দুটি ফাইনাল খেলার পর বিশেষ শর্তে হার্দিককে ফিরিয়ে আনে মুম্বাই। শর্তটাও বেশ কঠিন। পাঁচবার আইপিএল জেতানো রোহিতকে সরিয়ে তাকে দিতে হবে অধিনায়কত্ব। মুম্বাই তাতে রাজিও হয়ে যায়। রোহিতও তা মেনে নেন। তবে মুম্বাই, রোহিত এবং ধীরে ধীরে ভারত দলের সমর্থকরাও এই বিষয়টি নিয়ে চরম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মুম্বাই শুরুতে টানা কয়েক ম্যাচ হারার পর সেটা পেয়ে যায় ভিন্ন মাত্র। তবে চুপ করে থাকেন হার্দিক।
নিজের দেশের মাঠেই তাই একের পর এক দুয়োর শিকার হতে হয় হার্দিককে। খেলা যে মাঠেই হোক, তাকে দুয়ো দেওয়াটা নিয়মিত চিত্র হয়ে দাঁড়ায়। জাতীয় আক্রোশে পরিণত হন হার্দিক। মুম্বাইও ভালো করতে পারছিল না, তিনি নিজেও সেরাটা দিতে হন ব্যর্থ। অধিনায়কত্বও ছিল সাদামাটা। সব মিলে যে পরিস্থিতি দাঁড়ায়, তাতে মাঠে বা মাঠের বাইরে কোথাও রেহাই নেই হার্দিকের। যে যেখান থেকে পেরেছে, তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চেয়েছে, যা তা বলেছে। এবারও চুপ করেই থাকেন হার্দিক।
সবচেয়ে খারাপ সময়ে আমাদের প্রয়োজন হয় আপন মানুষদের। তবে হার্দিকের ভাগ্য এদিকেও খারাপ। স্ত্রীও কঠিন এই সময়ে তাকে ছেড়ে চলে যান। যা নিয়ে ছড়ায় নানা ধরণের বিতর্কিত খবর। অধিনায়ক, খেলোয়াড় তো বটেই, মানুষ হিসেবেও তাই আইপিএলের মাসগুলো তাই হার্দিকের জন্য দুঃস্বপ্নময় হয়ে উঠেছিল। এখানেও চুপই থাকেন হার্দিক।
এরই মাঝে যখন বিশ্বকাপ স্কোয়াড দেওয়া হয়, সেখানে হার্দিকের নাম দেখে আবার ক্ষেপে যান একদল মানুষ। একে তো পারফরম্যান্স নেই, তার ওপর রোহিতকে অসম্মান করা এমন একজন কেন বিশ্বকাপে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করবেন, তা নিয়ে কম আলোচনা হয়নি। যথারীতি একটা শব্দও করেননি হার্দিক।
২৯ জুন, বিশ্বকাপ ফাইনাল, বার্বাডোজ। ১৩ বছর পর ভারত বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। উল্লাসে ভাসছে স্টেডিয়ামে ও টেলিভিশনের সামনে থাকা কোটি ভক্ত। খেলোয়াড়রাও এদিক ওদিক ছুটছেন। তবে একজন চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইলেন। এরপর চোখ ভিজে গেল জলে। অবশ্য আর কীইবা করবেন! যে ঝড়টা বয়ে গেছে তার ওপর দিয়ে, যেভাবে সবচেয়ে কাছের মানুষ থেকে শুরু করে স্বদেশের মানুষ সবাই বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, একাকী সেই যুদ্ধটা সামাল দিতে হয়েছে তো তাকেই, হার্দিককেই। গোটা সময়ে চুপ করেই তো ছিলেন তিনি। তবে এদিন আনন্দ-বেদনা যেন মিলেমিশে গ্রাস করে ফেলল তাকে।
যাকে কেন্দ্র করে হার্দিকের সবার চোখে ভিলেন হয়ে যাওয়া, সেই রোহিত যখনই দেখলেন সতীর্থকে, এগিয়ে গিয়ে কোলে তুলে নিলেন। হার্দিক মাথা রাখলেন রোহিতের কাঁধে, জড়িয়ে ধরলেন শক্ত করে। চোখ দিয়েও তখনও পানি ঝরছে। রোহিত তাকে কী যেন বলছিলেনও। তবে হার্দিককে দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি যেন একটা নিস্তব্দ জগতে ঘোরের মধ্যে আছেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস মানসিকভাবে যেভাবে তিলে তিলে দুমড়ে মুচড়ে দেওয়া হয়েছিল তাকে, সেখান থেকে এভাবে ফিরে আসা, ফাইনালে জয়ের নায়ক হওয়া, এসব তো রুপকথাতেই সম্ভব কেবল।
ব্যাটার হিসেবে সাদা বলের ক্রিকেটে বেশ কার্যকর হার্দিক বোলার হিসেবে প্রায়ই রুপকথার গল্পই লিখেন। সেটা এতোটাই যে, তার বোলিংকে বলা হয় ‘গোল্ডেন আর্ম।’ কারণ, অসংখ্য ম্যাচে একটা বড় জুটি ভাঙা বা প্রচণ্ড চাপের মুখে আক্রমণে এসেই উইকেট নিয়ে হারা ম্যাচ জেতানোর কাজটা তিনি করেছেন। ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই যেমন। ভারতের কাছে সেদিন বাংলাদেশ যেভাবে ৩ বলে ২ রানের সমীকরণ মেটাতে ব্যর্থ হয়েছিল, সেদিন বোলারটা ছিলেন তরুণ হার্দিকই।
সময়ের সাথে এখন তিনি অনেক অভিজ্ঞ। বোলিংয়ে ধার বেড়েছে, মাথার ব্যবহারটাও তাই করেন বেশি বেশি। আর সেই কারণে হেনরিখ ক্লাসেন ও ডেভিড মিলার ক্রিজে থাকা অবস্থায় দক্ষিণ আফ্রিকার যখন প্রয়োজন মাত্র ২৪ বলে ২৬ রান, তখনও সেখান থেকে জেতার স্ক্রিপ্ট রচনা করতে পারেন হার্দিক। মাত্র চার রান দিয়ে সেই ওভারে ক্লাসেনকে বিদায় করার পর শেষ ওভারে যেভাবে প্রতিটি বল করেছেন স্নায়ুর সাথে লড়াই করে, সেটাই প্রমাণ করে মানসিকভাবে কতোটা শক্ত তিনি।
অবশ্য পুরো দেশই যখন বিপক্ষে অবস্থান নেয়, ছুঁড়ে ফেলতে চায় এবং একজন সেটাও পার করতে পারেন, তার মানসিকতা তো ইস্পাতসম কঠিন হতেই হবে। হার্দিক তেমনই একজন ক্রিকেটার। বরোদার একটা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা হার্দিক জীবন সংগ্রাম দেখেছেন খুব কাছ থেকে, অল্প বয়সেই। হয়ত সেটাই মানসিকভাবে তাকে এতোটা দৃঢ় থাকার শক্তি যোগায় সবচেয়ে কঠিন সময়েও। ফলে ক্লাসেন-মিলারদের হাতের মুঠো থেকে তিনি ম্যাচ বের করে আনতে পারেন। কারণ, এই ফাইনাল যে হার্দিকের হিরো হওয়ার মঞ্চ, পুরো দেশের ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার মঞ্চ। তিনি পেরেছেন সেই লড়াইয়ে জিততে, আর প্রমাণ করেছেন, পুরো দুনিয়া আপনার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেললেও আপনি নিজে তা করতে পারবেন না। আর তাহলেই কেবল আপনার দ্বারা সম্ভব মিরাকল ঘটানোর।
রোহিত, কোহলি, বুমরাহ বা কোচ দ্রাবিড়রা আলোচনার মুখ্য বিষয় হলেও নীরব যুদ্ধে জয়ের জন্য হার্দিককে আপনার মনে রাখতেই হবে। কারণ, হার্দিকরা যে হারতে জানে না!