১০ ম্যাচে নয় জয়, এল ক্লাসিকোর আগেই লা লিগায় হান্সি ফ্লিকের কোচিংয়ে চমৎকার ফুটবল খেলছিল বার্সেলোনা। তবে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ম্যাচে নজর থাকে সবার, এরকম ম্যাচেই বোঝা যায় দলের উন্নতির ধাপ। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে মৌসুমের প্রথম ম্যাচে সেই পরীক্ষায় লেটার মার্কস পেয়ে পাশ করেছেন এই জার্মান কোচ। রিয়ালকে বিধ্বস্ত করে তাই দল নিয়ে শুনিয়েছেন গর্বের কথা।
চলতি মাসের শেষটা বেশ আগে থেকেই বার্সেলোনার জন্য অগ্নিপরীক্ষা হিসেবেই দেখা হচ্ছিল। টানা দুই ম্যাচে যে খেলতে হয়েছে বায়ার্ন মিউনিখ ও রিয়ালের বিপক্ষে। জার্মান ক্লাবটিকে ৪-১ গোলে হারানোর পর লা লিগা চ্যাম্পিয়নদের গত শনিবার রাতের ম্যাচে ৪-০ গোলে হারিয়েছে দলটি। ইউরোপের শক্তিশালী দুই দলের বিপক্ষে পরপর দুই ম্যাচে এমন পারফরম্যান্স যেকোনো দলের জন্যই স্বপ্নের ব্যাপার।
আর তাই সংবাদ সম্মেলনে বার্সেলোনাকে নিয়ে বাড়তি উচ্ছাস ফুটে উঠল সাবেক বায়ার্ন কোচ ফ্লিকের কণ্ঠে। “আমি বার্সেলোনায় কাজ করতে পেরে এবং বার্সেলোনায় থাকতে পেরে খুব খুশি। এটা একটি দুর্দান্ত কাজ, আমি খুবই খুশি... আমরা একটি দুর্দান্ত ম্যাচ খেলেছি এবং আমি খুব গর্বিত।”
স্কোরলাইন যে সবসময় সঠিক কথা বলে না, সেটার একটা প্রমাণ হতে পারে এই ম্যাচ। প্রথমার্ধে বেশ ভালো খেলেছিল রিয়াল। কয়েকটি ভালো সুযোগ তো ছিলই গোলের, এমনকি কিলিয়ান এমবাপে কিছুটা ভাগ্যের সহায়তা পেলেই পেতে পারতেন গোলের দেখাও। বিপরীতে বার্সেলোনাও বিরতির আগ পর্যন্ত ছিল না সেরা ছন্দে। তবে দ্বিতীয়ার্ধে প্রতিপক্ষকে আর দাঁড়াতেই দেয়নি কাতালান ক্লাবটি। জোড়া গোল করেন রবার্ট লেভানদফস্কি, আর একটি করে লামিন ইয়ামাল ও রাফিনিয়া।
বিরতির পর বার্সেলোনার এমন খেলার রহস্য খোলাসা করেছেন ফ্লিক। “আমরা বল দিয়ে এবং ছাড়াও ভালোভাবেই চাপ দিয়েছি। আমাদের বলের দখল বেশি ছিল এবং সে কারণেই খেলা বদলে গেছে। ডিফেন্সের প্রচেষ্টা ছিল মুখ্য। আমরা অনেক অনুশীলন করেছি যে কীভাবে হাই লাইনে ডিফেন্স করতে হয় এবং আমরা কীভাবে বলের ওপর চাপ রাখতে চাই। পাশাপাশি এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে, আপনি যখন রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে খেলবেন, তখন খালি জায়গা না রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাদের দলে অবিশ্বাস্য সব খেলোয়াড় রয়েছে।”
১১ ম্যাচে ৩০ পয়েন্ট নিয়ে বার্সেলোনাই এখন আছে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে। ছয় পয়েন্ট পিছিয়ে দুইয়ে আছে রিয়াল।
বার্সেলোনা রীতিমত উড়ছে। বার্সাকে থামাতে গিয়ে কেউ বাধা পড়ছেন অফসাইডের ফাঁদে, আর তা না হলে বিপরীত পোস্টে ইয়ামাল-লেভানডফস্কি-রাফিনিয়ার মুহুর্মুহু আক্রমণে প্রতিপক্ষ ভেসে যাচ্ছে গোলবন্যায়। শেষ পাঁচ ম্যাচে রিয়াল-বায়ার্নসহ বার্সা গোল করেছে ২১ টা, সব প্রতিযোগিতা মিলে সেটা ৫০ ছুঁয়েছিল রেড স্টারের বিপক্ষে ম্যাচের আগেই। বার্সেলোনার এই ‘গোলমেশিন’ যেন অটো মোডে এভাবেই গোল করে যায়, সেটাই প্রত্যাশা বার্সেলোনার জার্মান কোচ হান্স দিতার ফ্লিকের।
রেড স্টারের বিপক্ষে এক পর্যায়ে ১-১ এ সমতা থাকলেও বার্সেলোনা ম্যাচটা শেষ করেছে ২-৫ স্কোরলাইনে। সে সঙ্গে ৭৪ বছরের পুরোনো একটা রেকর্ড ভেঙে চুরমার করে ফেলেছে ফ্লিকের দল। এই মুহূর্তে সব কম্পিটিশন মিলে ১৬ ম্যাচ খেলেছে বার্সেলোনা, তাতে ম্যাচপ্রতি ৩.৪ গোল হারে তারা গোল করেছে ৫৫ টি। এর আগে স্লোভাক কোচ ফার্দিনান্দ দাউচিকের অধীনে ১৯৫০-৫১ সালে বার্সেলোনা প্রথম ১৬ ম্যাচে করেছিল ৫৪ গোল। এবারের ভয়ঙ্কর বার্সেলোনার কাছে ভেঙে গেল এত বছরের পুরোনো রেকর্ডটাও, যা কি না অক্ষত ছিল লিওনেল মেসি, ইব্রাহিমোভিচ, সুয়ারেজ, নেইমারদের সময় যাবার পরও। ওসাসুসানের কাছে ৪-২ গোলে হারার পর প্রতি ম্যাচেই তিনের অধিক গোল করেছে কাতালান ক্লাবটি। এই ১৬ ম্যাচের মধ্যে তারা তিন বা এর অধিক গোল করেছে ১০ ম্যাচে।
আরও পড়ুন
জিতেও যে কারণে দলের পারফরম্যান্সে সন্তুষ্ট নন ফ্লিক |
কিন্তু এরকম ভয়াবহ গোলক্ষুধার পেছনে রহস্যটা কী? হান্সি ফ্লিক কী এমন জাদু করলেন যে খেলোয়াড়রা গোলমুখে এত ধারাবাহিক হয়ে উঠেছে? উত্তরটা স্মিত হেসে ফ্লিক নিজেই দিয়েছেন, বলছেন তার ফুটবলারদের মধ্যে ‘প্রতিযোগিতার মানসিকতা’ থাকার কারণেই বার্সায় চলছে সুসময়-
“আমরা প্রতিটা ম্যাচে আলাদা করে নজর দিচ্ছি, সেটা আপনারাও হয়তো দেখছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ম্যাচে খেলোয়াড়রা ওদের সেরাটা দিচ্ছে। মাঠে সেটা ওরা ভালো বোঝে এবং তাদের সফল হতে দেখাটা আনন্দদায়ক।”
বার্সেলোনার এই গোলের ধারা অব্যাহত রাখার ব্যাপারেও জোর দিচ্ছেন ফ্লিক, বলছেন মৌসুমের এখনো অনেক সময় বাকি-
“আশা রাখছি ওরা এমনটা ধরে রাখতে পারবে। আমাদের সেই আত্মবিশ্বাসটা আছে। এটা শুধু একটা ম্যাচে ভালো করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং আমরা মৌসুমে এখন পর্যন্ত যে কয়টা ম্যাচ খেলেছি– সেটা মাথায় রেখেই আমরা এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চাই।”
চ্যাম্পিয়নস লিগে এরকম ম্যাচের পর ম্যাচে গোল করা অতীত বার্সেলোনার সন্ধান পেতে চাইলে আপনাকে ফিরে যেতে হবে ২০১১-১২ সালে। সেবার টানা তিন ম্যাচে তিন বা তার অধিক গোল করেছিল বার্সেলোনা, ১২ বছর পর সেটা বার্সেলোনা আবারো করে দেখালো ইয়াং বয়েজ আর রেড স্টারের জালে পাঁচ এবং বায়ার্নের জালে ৪ গোল দিয়ে।
আরও পড়ুন
এল ক্লাসিকোর জয়ে গর্বিত ফ্লিক |
চ্যাম্পিয়নস লিগে ৪ ম্যাচ শেষে ৯ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের ষষ্ঠ স্থানে আছে বার্সেলোনা। চ্যাম্পিয়নস লিগে বার্সেলোনার পরবর্তী অ্যাসাইনমেন্ট এবারের চমক ফ্রেঞ্চ ক্লাব ব্রেঁস। তবে তার আগে লা লিগাতে রিয়াল সোসিয়েদাদ ও সেলতা ভিগোর সঙ্গে ম্যাচ খেলবে তারা।
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, লিওনেল মেসির পর ৩য় ফুটবলার হিসেবে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে শততম গোলদাতার তালিকায় ঢুকতে যাচ্ছেন রবার্ট লেভানদোভস্কি। এখন পর্যন্ত উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে এই স্ট্রাইকারের গোল সংখ্যা ৯৯।
চ্যাম্পিয়নস লিগে গেল রাতে রেড স্টারের বিপক্ষে জোড়া গোল করে নিজেকে ৯৯’র ঘরে নিয়েছেন বার্সেলোনার এই স্ট্রাইকার। তিন অঙ্কের ম্যাজিকাল ফিগারে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ব্রেস্টের বিপক্ষে পরের ম্যাচের জন্য। রেড স্টারের বিপক্ষে মাঠে ছিলেন ৭৮ মিনিট পর্যন্ত, পুরো সময় পেলে হয়তো চ্যাম্পিয়নস লিগে শততম গোলের অপেক্ষাটা ফুরিয়ে ফেলতে পারতেন এই স্ট্রাইকার। ম্যাচ শেষে বার্সেলোনা কোচ হ্যান্সি ফ্লিকও রসিকতা করে সেই আফসোসটাই করেছেন-
“এটা আমি জানতাম না, জানলে হয়তো পুরো ম্যাচ না খেলিয়ে আমি তাকে বদল করতাম না।”
এর আগে বায়ার্ন মিউনিখ ও বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচ খেলেছেন লেভানদোভস্কি। ৯৯ চ্যাম্পিয়নস লিগ গোলের ৬৯টাই করেছেন বাভারিয়ানদের হয়ে। যা একক কোন ক্লাবের হয়ে গোলের হিসেবে রয়েছে ৪র্থ স্থানে। বার্সেলোনার জার্সি গায়ে মেসির গোল ১২০, রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর গোল ১০৫, কারিম বেনজেমাও রিয়ালের হয়ে করেছেন ৭৮টি গোল।
আরও পড়ুন
ভিনির মন খারাপ, তবে সেটা ভ্যালেন্সিয়ার বন্যার্তদের জন্য : আনচেলত্তি |
২০১৯/২০ চ্যাম্পিয়নস লিগে এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি গোল করেছিলেন রবার্ট লেভানদোভস্কি। সেবার বায়ার্ন মিউনিখকে ইউরোপ সেরার মুকুট এনে দিয়েছিলেন এই পোলিশ স্ট্রাইকারই। গোল করেছিলেন পুরো আসর জুড়ে ১৫টা।
বার্সেলোনার হয়ে এই মৌসুমে ৪ ম্যাচে গোল করেছেন ৫টি। সব মিলিয়ে বার্সার জার্সিতে চ্যাম্পিয়নস লিগ গোল হলো ১৩টি।