৬ জুলাই ২০২৪, ৭:০২ পিএম
লোকে বলে তিনি ভাঙেন না, অবশ্য শুধু লোকে না ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো নিজেই বলেন তা। ভাঙা গড়ার খেলার নামই তো জীবন। আর ফুটবল তো তারই অংশ। অদম্য মানসিকতা ধরে রাখা রোনালদোকে আপনি খুব একটা হতাশ হতে না দেখারই কথা। তবে পর্তুগালের জার্সিতে আপনি দেখেছেন অন্য এক রোনালদোকে। যিনি কাঁদেন, হাসেন, আবার রাগে ক্ষোভে অধিনায়কের আর্মব্যান্ডও ছুঁড়ে মারেন। ২০০৪ সালে তার যাত্রা শুরুটা হয় ইউরোতে। দুই দশক পর ফ্রান্সের সাথে টাইব্রেকারে হেরে শেষ হয়েছে ইউরো যাত্রা। প্রাপ্তির খাতায় এক শিরোপা, আর ইউরোর সর্বোচ্চ গোল, অ্যাসিস্ট কিংবা ম্যাচ খেলার রেকর্ড সবই তার দখলেই।
২০০৪ ফাইনাল আর কান্না
রোনালদোর পর্তুগাল ক্যারিয়ারের কথা মাথায় আনুন। নিশ্চিতভাবে সবার আগে আপনার স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠবে ২০১৬ তে ইউরো জয়ের ছবি, দেশের জার্সিতে প্রথম শিরোপা জিতে রোনালদোর সেই উদযাপন তো এখনও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা মেলে হরহামেশাই। রোনালদোর ট্রেডমার্ক উদযাপন নিশ্চিতভাবে আপনার চিন্তার জগতে ঘুরপাক খাবে। তবে রোনালদো সমর্থক হলে আরও একটা ছবিও আপনার মাথায় আসারই কথা।
২০০৪ সালে ইউরোর ফাইনালে ঘরের মাঠে হারার পর মাঠে কান্নায় ভেঙে পড়া তরুণ রোনালদোর সেই স্মৃতি হারানোর কথা না। সেদিন তরুণ রোনালদো পারেননি, লুইস ফিগো, ডেকোরা মিলেও ঘরের মাঠে পর্তুগালকে শিরোপা জেতাতে পারেননি। আর থামানো যায়নি ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর কান্নাও।
সেবার ফিগো, ডেকোদের মাঝেই আলো কাড়েন রোনালদো। মাঠে নেমেছিলেন সবগুলো ম্যাচেই। ৬ ম্যাচের ৪ ম্যাচই ছিলেন মূল একাদশে, বাকি দুই ম্যাচ মাঠে নেমেছিলেন বদলি হিসেবে। করেছিলেন ২ গোল, সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছিলেন দুটি। ঘরের মাঠে ফাইনালে কাছাকাছি গিয়েও শিরোপা উঁচিয়ে ধরা হয়নি রোনালদোদের। তাতে কান্নাই হয়েছিল সঙ্গী।
২০০৮ তারুণ্যের পর্তুগালের হতাশাই সঙ্গী
ফিগো চলে গেলেন, সেবার মূল আলোচনা রোনালদোকে ঘিরেই। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে সে মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে এসেছিলেন পর্তুগালের ডেরায়। প্রত্যাশার চাপটাও তার ওপর জেঁকে বসেছিল তখন। সাথে পেয়েছিলেন ইউনাইটেড সতীর্থ নানিকে। তবে সেবার আর বেশি দূর যাওয়া হয়নি তাদের। জার্মানির কাছে শেষ ষোলোতে হেরেই বিদায় নিতে হয়েছে পর্তুগালকে।
রোনালদো খেলেছিলেন তিন ম্যাচ, করেছিলেন এক গোল আর দুই অ্যাসিস্ট। শেষ ষোলোতে জার্মানির সাথে ছিলেন নিজের ছায়া হয়েই, তাতে বিদায়ের ঘণ্টা বেজে যায় পর্তুগালের। আর রোনালদোর সঙ্গী আরও একবার অপ্রাপ্তি, আর একরাশ হতাশা।
২০১২ টাইব্রেকারে আর হৃদয় ভাঙার গল্প
রীতিমত গ্রুপ অব ডেথেই পড়েছিল সেবার পর্তুগাল। জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্কের মতো শক্তিশালী দলের সাথে একই গ্রুপে পড়ে তারা। তাতে শঙ্কা জাগে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেওয়ার। তবে দলে যখন আছে রোনালদো তখন অসম্ভবও হয়ে যায় সম্ভব। প্রথম ম্যাচে তারা জার্মানির সাথে দেখে হার। দ্বিতীয় ম্যাচে জমজমাট লড়াইয়ে ডেনমার্কের সাথে জয় মেলে পর্তুগালের। প্রথম দুই ম্যাচে খুব একটা নজর কাড়তে পারেননি রোনালদো।
তবে শেষ ম্যাচে ঠিকই জ্বলে উঠেন তিনি। নেদারল্যান্ডসের সাথে দল পিছিয়ে পড়লেও জোড়া গোলে নিশ্চিত করেন পর্তুগালের জয়। শেষ ষোলোতে চেক রিপাবলিকের ম্যাচেও ত্রাতা এই রোনালদো। তার একমাত্র গোলের পর্তুগাল পা রাখে কোয়ার্টার ফাইনেল।
প্রতিপক্ষ হিসেবে পায় স্পেনকে। তখন রীতিমত উড়ছে দলটা। জাভি, ইনিয়েস্তা, ভিয়া, পুয়েল, ক্যাসিয়াসদের নিয়ে একেবারে তারকাভরা এক দল। স্পেনের সোনালী প্রজন্মের সাথে পেরে উঠেনি পর্তুগাল। তবে টেক্কা দিয়েছে ঠিকঠাক। নির্ধারিত সময়ে গোলশূন্য ড্রয়ের পর টাইব্রেকারে গিয়ে হার মানতে হয় পর্তুগালকে। অবশ্য সতীর্থদের মিসে রোনালদো সেবার শটও নিতে পারেননি। তাতে আরও একবার রোনালদোকে ফিরতে হয় খালি হাতে।
২০১৬ রোনালদোর স্বপ্ন পূরণ, আর পর্তুগালের প্রথম শিরোপা
টুর্নামেন্ট শুরুর আগে খুব একটা আলোচনা পর্তুগালকে নিয়ে হয়নি। নানি তখন ফর্ম হারিয়ে ফেলেছেন, রোনালদো রিয়ালের হয়ে দারুণ সময় কাটালেও মাঝমাঠ কিংবা ডিফেন্ড কোথাও খুব একটা ভরসার জায়গা ছিল না। প্রথম ম্যাচেই দলের অবস্থা বোঝা হয়ে গেছে। আইসল্যান্ডের সাথে ড্র করে বসে তারা। তাতে চাপ দিয়ে শুরু হয় তাদের টুর্নামেন্ট যাত্রা।
দ্বিতীয় ম্যাচে আবারও ড্র। অস্ট্রিয়ার সাথে রোনালদো পেনাল্টি মিস করে তখন রীতিমত ভিলেন বনে গেছেন। শেষ ম্যাচ তাই জয় ছাড়া তাদের কোনো বিকল্প নেই। ড্র করলেও অবশ্য তাদের সামনে সুযোগ ছিল তৃতীয় সেরা হয়ে পরের পর্বে যাওয়ার। তখনই রোনালদো দেখান ভেল্কি। প্রথম পিছিয়ে পড়লেও বিরতির আগে তার দেওয়া দারুণ থ্রু পাস থেক পর্তুগালকে সমতায় ফেরান নানি। দ্বিতীয়ার্ধে টানা দুইবার এগিয়ে যায় হাঙ্গেরি, আর দুই বারই রোনালদো সমতায় ফেরান পর্তুগালকে। ব্যাকহিলে করা একটা গোল তো ক্যারিয়ারে অন্যতম সেরা গোলই হিসেবেই জায়গা পেয়ে আছে।
গ্রুপ পর্বের তৃতীয় সেরা দল হয়ে তারা যায় শেষ ষোলোতে। যেখানে প্রতিপক্ষ হিসেবে পায় ক্রোয়েশিয়াকে। অতিরিক্ত সময়ে যাওয়া ম্যাচ শেষ মূহর্তে জয় পায় পর্তুগাল। কোয়ার্টার ফাইনালে প্রতিপক্ষ ছিল পোলান্ড। এবার জয় পেতে পর্তুগালকে অপেক্ষা করতে হয়েছে টাইব্রেকার পর্যন্ত।
নকআউটে দুই ম্যাচে রোনালদোর পারফরম্যান্স নিয়ে উঠেছিল প্রশ্ন। তবে সেমিফাইনালে ওয়েলসের সাথে এক গোল আর অ্যাসিস্ট করে নিন্দুকদের চুপ করান তিনি, দলকে তোলেন ফাইনালে। যেখানে প্রতিপক্ষ স্বাগতিক ফ্রান্স। নামেভারে দলটাকে হারানো কঠিন কাজই বটে। তারমাঝে প্রথমার্ধে চোট পেয়ে মাঠ থেকে ওঠে যেতে পর্তুগাল অধিনায়ককে। তাতে আশাটা অনেকটাই নেভে যাওয়ার মতই। সেই সাথে কান্নাভেজা চোখ নিয়ে মাঠ ছাড়ার সময় ভক্তকুলকে কাঁদিয়েই মাঠ ছাড়েন তিনি। অবশ্য রোনালদোর এমন বিদায়ে পর্তুগালের ফুটবলাররা ভেঙে পড়েননি, নিংড়ে দেন নিজেদের সারাটা। অতিরিক্ত সময়ে এদেরের করা গোল স্বপ্ন পূরণ হয় রোনালদোর। আর পর্তুগাল প্রথমবারের মতো স্বাদ পায় আন্তর্জাতিক কোনো শিরোপার।
২০২০ প্রাপ্তি রোনালদোর অপ্রাপ্তি পর্তুগালের
আবারও কঠিন গ্রুপই তাদের সঙ্গী হয়। ফ্রান্স, জার্মানির সাথে সেবার পর্তুগালের গ্রুপে ছিল হাঙ্গেরি। প্রথম ম্যাচে হাঙ্গেরির সাথে তিন গোলের বড় ব্যবধানে জয় মেলে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের। জোড়া গোল করেন রোনালদো। জার্মানির সাথে গোল পেলেও দলকে জেতাতে পারেননি পর্তুগাল অধিনায়ক। তবে ফ্রান্সের সাথে আবারও জোড়া গোল করে পর্তুগালকে ড্র এনে দেন রোনালদো। তাতে তৃতীয় সেরা হয়েই তারা পা রাখে শেষ ষোলোতে। তবে সেখানে গিয়ে বেলজিয়ামের সাথে জ্বলে উঠতে পারেননি রোনালদো, তাতে পর্তুগালও আর পেরে ওঠেনি। বিদায় নেয় শেষ ষোলো থেকেই। তবে রোনালদো পাঁচ গোল করে যৌথভাবে জেতেন গোল্ডেন বুট।
২০২৪ এ যেন ভিন্ন রোনালদো
টুর্নামেন্টের অন্যতম ফেভারিট হিসেবেই এবার পর্তুগাল খেলতে আসে ইউরো। পুরো দলে তারকার ছড়াছড়ি। তার মাঝেও সব আলো ৩৯ বছর বয়সী রোনালদোর দিকেই। তবে বছরের পর বছর পর্তুগালকে টেনে নেওয়া এই মহাতারকা এবার করেছেন হতাশই করেছেন। গ্রুপ পর্বে তিন ম্যাচে পাননি কোনো গোলের দেখা, করেছেন এক অ্যাসিস্ট। আর শেষ ষোলোতে তো স্লোভেনিয়ার সাথে ভুলে যাওয়ার মতই একটা রাত কাটিয়েছেন। পাননি গোলের দেখা, মিস করেছেন পেনাল্টি, এরপর কান্নায় ভেঙে পড়ে হয়েছেন সমালোচনার শিকারও।
ফ্রান্সের সাথে সুযোগ ছিল সব সমালোচনার জবাব দেওয়ার। তবে এই দফায় তা আর পারেননি রোনালদো। তাতে চোখের কোণে পানি নিয়ে ইউরোকে বিদায় বলতে হয়েছে তাকে। শুরুটাও ছিল কান্না দিয়ে, শেষটাও হয়েছে ঠিক একই রকম। মাঝে অবশ্য ইউরো জিতে পর্তুগালকে হাসিয়েছেন, হেসেছেন নিজেও।
১ দিন আগে
২ দিন আগে
২ দিন আগে
৫ দিন আগে
৬ দিন আগে
৭ দিন আগে
১৯ দিন আগে